নতুন প্রক্রিয়ায় নতুন সমস্যা - ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন

আপনার যদি ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকে, তাহলে সেটি পেতে আপনাকে একটি জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং তার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। বর্তমানে প্রায় ১৮টি নাগরিক সেবা পেতে এ সনদ আবশ্যক। তাই জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করা এখন খুবই জরুরি।

শারমিন ইসলাম ও তার স্বামীর ১৬ ডিজিটের সনদ আছে। কিন্তু গত মাসে তারা এই সনদ ব্যবহার করে মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের অনলাইন আবেদন করতে পারেননি। ডিজিটাল জন্ম সনদের আবেদন প্রক্রিয়ায় বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও শুধু ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন গ্রহণযোগ্য হয়।



মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে জন্ম সনদের প্রয়োজন।

শারমিন স্বনামধন্য পত্রিকাকে সম্প্রতি বলেন, 'কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাড়া আমার মেয়েকে ভর্তি করবে না। এখন আমি আর আমার স্বামী নিজেদের জন্ম নিবন্ধন সনদ জোগাড়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। মেয়ের সনদ পেতে আগে আমাদেরটা লাগবে।'

সরকার গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮টি নাগরিক সেবার জন্য অনলাইন জন্ম নিবন্ধন আবশ্যক করেছে। এই সেবাগুলোর মধ্যে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন, পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন।

এছাড়াও, ১২ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুদের করোনাভাইরাস টিকা পেতেও ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়।

শারমিনের মতো হাজারো মানুষ এখন এই গুরুত্বপূর্ণ সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধনের জটিল প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রিতার জন্য তারা সবাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

শারমিন বলেন, 'নতুন আবেদন প্রক্রিয়া এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন ১৭ ডিজিটের চেয়ে কম সংখ্যার কোনো জন্ম নিবন্ধন ব্যবহার করে আবেদন করলে সেটি গৃহীত না হয়।'

তিনি অভিযোগ করেন, এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী কর্মীরা এই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে ফায়দা লুটছেন।

জন্ম নিবন্ধন পোর্টালে এখন প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ করে আবেদন জমা পড়ছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কিছু আঞ্চলিক কার্যালয় সরেজমিনে পরিদর্শন করে এ সংবাদদাতা সেসব জায়গায় বেশ কয়েকজন দালালকে দেখতে পান। দালালরা টাকার বিনিময়ে দ্রুত সনদ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) খিলগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ১ সপ্তাহের মধ্যে ৩টি জন্ম সনদ পেতে একজন সেবাগ্রহীতাকে দেখা যায় তিনি একজন দালালকে ৭ হাজার টাকা দিচ্ছেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি উক্ত স্বনামধন্য পত্রিকাকে বলেন, 'দালালদের সাহায্য না নিলে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা অনেক ধরনের কাগজ চাইবেন এবং সবগুলোর মধ্যেই "ভুল" খুঁজে পাবেন। এ ধরনের ভোগান্তি এড়াতে আমাকে এই টাকাটা খরচ করতে হচ্ছে।'

ডেলিভারি রশিদে বলা হয়, প্রয়োজনীয় নথি জমা দেওয়ার ১৫ দিন পর সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু এ সনদ পেতে ১ মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে অনেককে।

১৭ ডিজিটের সনদ পাওয়ার আবেদন প্রক্রিয়াটি এত জটিল যে অনেকেই ভুল করেন। ফলে তাদেরকে আরও বেশি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল সংশোধনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

যেমন, রায়েরবাজার বস্তির বাসিন্দা রিকশা চালক আবদুল গফুর সনদের জন্য আবেদন করতে পারেননি। কারণ সিটি করপোরেশনের কর্মীরা 'বস্তি এলাকা'কে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হননি।

ডিএসসিসির আজিমপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষমাণ অবস্থায় গফুর বলেন, 'আমার জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী আমার স্থায়ী ঠিকানা ১৫, মধুবাজার (রায়েরবাজার বস্তি)। কিন্তু তারা আমাকে বলেছেন নিজের গ্রামে গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিকত্বের সনদ নিয়ে আসার জন্য।'

তিনি জানান, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত তার গ্রামটি দীর্ঘদিন আগে ব্রক্ষপুত্র নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে।

'আমি রাজধানীর মধুবাজার এলাকায় প্রায় ২ দশক ধরে বসবাস করছি। আমার সব সন্তান এখানে জন্ম নিয়েছে। এটা খুবই হাস্যকর যে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ঠিকানার কারণে আমি জন্ম সনদ পাচ্ছি না', যোগ করেন গফুর।

বানেছা বেগম নাগরিকত্ব সনদ জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু সেখানে স্বামীর নাম লেখা না থাকার কারণ দেখিয়ে তার আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়।

গফুরের মতো, তাকেও বলা হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নথি সংশোধন করিয়ে আনতে।

বানেছা বলেন, 'আমি আমার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালাম। সেখানে আমার স্বামীর নাম লেখা আছে, কিন্তু তারা সেটি গ্রহণ করেননি। তারা জানান, জন্ম সনদ পেতে হলে আমাকে নাগরিকত্বের সনদ সংশোধন করাতে হবে।'

জন্ম সনদের কোনো ভুল তথ্য সংশোধনের প্রক্রিয়াটি আরও জটিল।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী তৌহিদ উর রহমান তার মেয়ের জন্মতারিখ সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গত মাসে কর্মকর্তারা তাকে জানান, সে মুহূর্তে সার্ভারে সংশোধনের প্রক্রিয়া বন্ধ আছে।

তারপর তিনি ঢাকা জেলা কমিশনারের কার্যালয়ে একটি আবেদন জমা দিয়ে জানান যে তার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন বাতিল করতে চান এবং নতুন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কথাও জানান।

তৌহিদ বলেন, 'এরপর প্রায় এক মাস সময় গেল, কিন্তু আমি এখনো কোনো উত্তর পাইনি। দেরির কারণে আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে।'

শাহাদাত হোসেন (ছদ্মনাম) ও তার স্ত্রী কারওয়ানবাজারের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক অফিসে কয়েক মাস আগে জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করেছেন। তারা দালালের সাহায্য না নিয়ে নিজেরাই সঠিকভাবে আবেদনপত্র পূরণ করেন।

ডেলিভারির দিন শাহাদাত দেখেন, মুদ্রিত সনদে তার মায়ের নামের বানান ভুল। যদিও অনলাইনে বানান ঠিক ছিল।

তার স্ত্রীর সনদে তার মায়ের নাম প্রিন্ট ও অনলাইন, দুই সংস্করণেই ভুল বানানে লেখা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমার ধারণা তারা ইচ্ছা করেই বানান ভুল করেছেন, কারণ আমরা দালালের সহায়তা না নিয়ে নিজেরাই আবেদন করেছিলাম। এখন আমাদের এই নামগুলো সংশোধন করার জন্য ঝামেলা পোহাতে হবে।'

ডিএসসিসি ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মাহবুবুল আলম ডেইলই স্টারকে জানান, 'খিলগাঁওয়ের এই ওয়ার্ডে বেশ কিছু নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এ কারণে এখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করে।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে গ্রাহকদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।'

ডিএনসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সাজ্জাদ হোসেনও মাহবুবুলের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

সাবেক ও সর্বশেষ রেজিস্ট্রার জেনারেল মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী স্বনামধন্য পত্রিকাকে জানান, তারা প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ জন্ম নিবন্ধনের আবেদন পাচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমরা এটা অস্বীকার করতে পারি না যে, অনেকেই সমস্যায় পড়ছেন, কারণ তাদের হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকা সত্ত্বেও তাদের অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হচ্ছে। কিন্তু একবার সবার অনলাইন নিবন্ধন হয়ে গেলে পুরো জাতি উপকৃত হবে। এর মাধ্যমে আমরা সব ধরনের নাগরিক সেবা দ্রুততার সঙ্গে দিতে পারব। সুতরাং, নাগরিকদের ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য যত দ্রুত সম্ভব আবেদন করার জন্য আমাদের উৎসাহ দেওয়া উচিৎ।'

মুস্তাকিম বলেন, 'একজন নাগরিকের নাম ও জাতীয়তা চিহ্নিত করার জন্য জন্ম নিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি উপকরণ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র সদ্যোজাত শিশুটিকেও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেয়। শিশু জন্ম নেওয়ার পরপরই জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি।'

দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল জানান, তাদের জনবল খুবই সীমিত।

'আমরা এই প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে এর সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাবে,' বলেন তিনি।

অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, যেহেতু আবেদন অনলাইনে করা হয় এবং মানুষকে কিছু কাগজ জমা দিতে হয়, এ ক্ষেত্রে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।

Post a Comment

0 Comments