ভারত বনাম পাকিস্তান: সামরিক শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ

দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। কাশ্মীর ইস্যুসহ বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কারণে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বজায় রয়েছে, যা মাঝে মাঝে সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এই ব্লগে আমরা ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিভিন্ন স্তর—জনবল, স্থল, বিমান, নৌ, পারমাণবিক ক্ষমতা, এবং প্রতিরক্ষা বাজেট—এর বিস্তারিত তুলনা করব। তথ্যগুলো প্রধানত গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ২০২৫, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI), এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত।

compare india and pakistan military power

সামগ্রিক র‍্যাঙ্কিং

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ২০২৫ সূচক অনুযায়ী, ১৪৫টি দেশের মধ্যে ভারত সামরিক শক্তিতে বিশ্বে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে (স্কোর: ০.১১৮৪), যেখানে পাকিস্তান ১২তম (স্কোর: ০.২৫১৩)। এই র‍্যাঙ্কিং জনশক্তি, সামরিক সরঞ্জাম, অর্থনৈতিক অবস্থা, এবং ভৌগোলিক কারণসহ ৬০টির বেশি বিষয় বিবেচনা করে নির্ধারিত হয়। ভারতের বৃহৎ জনসংখ্যা, উচ্চ প্রতিরক্ষা বাজেট, এবং বৈচিত্র্যময় সামরিক সম্পদ এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ। পাকিস্তান, ছোট অর্থনীতি এবং চীনের উপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও, কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রেখেছে।

জনশক্তি

জনশক্তি যেকোনো সামরিক বাহিনীর মেরুদণ্ড। ভারত ও পাকিস্তানের জনশক্তির তুলনা নিম্নরূপ:

  • ভারত:
    • সক্রিয় সেনা: ১৪.৪ মিলিয়ন
    • রিজার্ভ সেনা: ১১.৫ মিলিয়ন
    • আধাসামরিক বাহিনী: ২.৫ মিলিয়ন
    • সামরিক সেবার জন্য উপযুক্ত জনসংখ্যা: ৬৫ মিলিয়ন

     

  • পাকিস্তান:
    • সক্রিয় সেনা: ৬৫০,০০০
    • রিজার্ভ সেনা: ৫৫০,০০০
    • আধাসামরিক বাহিনী: ৩০০,০০০
    • সামরিক সেবার জন্য উপযুক্ত জনসংখ্যা: ১০ মিলিয়ন

ভারতের জনসংখ্যা (১.৪ বিলিয়ন) পাকিস্তানের (২৪০ মিলিয়ন) তুলনায় অনেক বেশি, যা এর বিশাল সামরিক জনশক্তির ভিত্তি। তবে পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনী, যেমন স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (SSG), আকারে ছোট হলেও উচ্চ দক্ষতার জন্য সমীহ করা হয়।

স্থল বাহিনী

স্থল বাহিনীতে ভারত সংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে:

  • ট্যাঙ্ক:
    • ভারত: ৪,৬১৪টি (টি-৯০ ভিষমা, অর্জুন এমকে-১)
    • পাকিস্তান: ৩,৭৪২টি (চীনের ভিটি-৪, আল-ফাহাদ)

     

  • সাঁজোয়া যান:
    • ভারত: ১০০,০০০+ (আনুমানিক)
    • পাকিস্তান: ৫০,০০০ (আনুমানিক)

     

  • কামান:
    • ভারত: ৮,৫০০টি (১,৫০০ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজার)
    • পাকিস্তান: ৪,৪৭২টি (৩৭৫ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজার)

ভারতের ট্যাঙ্ক ও কামানের সংখ্যা বেশি এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। পাকিস্তান চীনের সহায়তায় তার ট্যাঙ্ক বহর আধুনিকায়ন করছে, তবে সংখ্যাগত দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

বিমান বাহিনী

বিমান বাহিনীতে ভারতের আধিপত্য সুস্পষ্ট:

  • মোট বিমান:
    • ভারত: ২,২২৯টি
    • পাকিস্তান: ১,৩৯৯–১,৪৩৪টি

     

  • যুদ্ধবিমান:
    • ভারত: ৬৪৩টি (১৩০টি বোমারু, রাফাল, সুখোই-৩০ এমকেআই)
    • পাকিস্তান: ৩২৮–৪১৮টি (৯০টি বোমারু, এফ-১৬, জেএফ-১৭ থান্ডার)

     

  • হেলিকপ্টার:
    • ভারত: ৭৩৬টি
    • পাকিস্তান: ৫৪৫টি (এএইচ-১এফ কোবরা সহ)

     

  • এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (AWACS):
    • ভারত: ৩টি
    • পাকিস্তান: ৭টি

ভারতের বিমানবহর বড় এবং বৈচিত্র্যময়, যদিও স্কোয়াড্রনের ঘাটতি রয়েছে। ফ্রান্স থেকে আমদানি করা রাফাল যুদ্ধবিমান পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এবং আকাশে ১৫০ কিমি দূরে আঘাত হানতে পারে। পাকিস্তানের এফ-১৬ এবং জেএফ-১৭ থান্ডার কার্যকর, তবে সংখ্যায় কম। পাকিস্তানের AWACS-এর সংখ্যাগত সুবিধা নজরদারি ক্ষমতা বাড়ায়।

নৌবাহিনী

নৌবাহিনীতে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্ট:

  • যুদ্ধজাহাজ:
    • ভারত: ১৩৭টি (২টি বিমানবাহী রণতরী, ১৬টি সাবমেরিন, ১৮টি ডেস্ট্রয়ার)
    • পাকিস্তান: ৮০টি (৫টি সাবমেরিন, ১০টি ফ্রিগেট)

     

  • বিমানবাহী রণতরী:
    • ভারত: আইএনএস বিক্রান্ত, আইএনএস বিক্রমাদিত্য
    • পাকিস্তান: কোনোটিই নেই

ভারতের নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম, যেখানে পাকিস্তানের নৌবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট এবং প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকায় সীমাবদ্ধ।

পারমাণবিক ক্ষমতা

উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (২০২৪) অনুযায়ী:

  • ভারত: ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড
  • পাকিস্তান: ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড

কতগুলো ওয়ারহেড কার্যক্ষম তা অস্পষ্ট। ভারতের অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্র ৫,০০০ কিমি পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে, যেখানে পাকিস্তানের শাহিন-৩ ক্ষেপণাস্ত্র ২,৭৫০ কিমি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ভারতের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে, তবে এর কৌশলগত অস্ত্র ভারতের বড় শহরগুলোকে লক্ষ্য করতে সক্ষম।

প্রতিরক্ষা বাজেট

প্রতিরক্ষা বাজেট সামরিক শক্তির আধুনিকায়নের প্রধান চালিকাশক্তি:

  • ভারত: ২০২৫ সালে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলার (মোট বাজেটের ১৩%)
  • পাকিস্তান: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার

ভারতের বিশাল অর্থনীতি এবং উচ্চ বাজেট এটিকে উন্নত প্রযুক্তি এবং সরঞ্জাম ক্রয়ে সুবিধা দেয়। পাকিস্তান চীনের সাশ্রয়ী প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, তবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এর আধুনিকায়নকে বাধাগ্রস্ত করে।

কৌশলগত সুবিধা ও দুর্বলতা

  • ভারত:
    • সুবিধা: বৃহৎ জনশক্তি, বিশাল অর্থনীতি, উন্নত প্রযুক্তি, নৌশক্তিতে আধিপত্য।
    • দুর্বলতা: আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, চীন-পাকিস্তানের দ্বৈত হুমকি, পুরোনো বিমানবহর।

     

  • পাকিস্তান:
    • সুবিধা: কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র, চীনের সমর্থন, অপ্রতিসম যুদ্ধকৌশলে দক্ষতা।
    • দুর্বলতা: ছোট অর্থনীতি, পুরোনো সরঞ্জাম, আঞ্চলিক উত্তেজনা।

উপসংহার

সংখ্যাগত এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভারত সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এর বৃহৎ জনশক্তি, উচ্চ বাজেট, এবং বৈচিত্র্যময় সামরিক সম্পদ এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষমতা, চীনের সমর্থন, এবং কৌশলগত অস্ত্র এটিকে একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ করে তুলেছে। যুদ্ধ শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে না; ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং সৈন্যদের মনোবলও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে যুদ্ধ উভয় পক্ষের জন্যই বিধ্বংসী হবে। তাই শান্তিপূর্ণ কূটনীতি এবং সংলাপই এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে স্থিতিশীলতার পথ হতে পারে।

Post a Comment

0 Comments